’আল্পস পর্বতমালায় ঘেরা স্বর্গভূমি’

গতবছরের অক্টোবরে ইউরোপ ভ্রমনে ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড নিয়ে আমার কিছু অনুভূতি ও ভাল লাগার কথা ব্যক্ত করলাম——

’আল্পস পর্বতমালায় ঘেরা স্বর্গভূমি’

রোম থেকে যখন বাসে করে সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছিলাম তখন মন অনেকটাই খারাপ ছিল। কারন আমাদের ট্যুর আইটিনারীতে রোমের পরে ভেনিসে যাওয়ার প্লান ছিল। সে অনুযায়ী ভেনিসে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট করা হয়েছিল, কিন্তু ওখানে কোন হোটেল নেয়া হয়নি। ভেবেছিলাম ওইদিন সারাদিন ভেনিস ঘুরে রাতেই বাসে করে জুরিখ চলে যাবো এবং টিকেটও সে অনুযায়ী কাটা ছিল। জীবন আসলে সবসময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না, আমরা ভাবি একটা হয় আরেকটা। আমার প্রচন্ড ঠান্ডা আমার ভেনিসে যাওয়ার অন্তরায় হয়ে দাড়াল। যেহেতু বাসে রোম থেকে আমাকে ১২ ঘন্টা জার্নি করে ভেনিসে যেতে হবে এবং সারাদিন ঘোরাঘুরি করে সেদিনই রাতে ১০ ঘন্টা ভ্রমন করে জুরিখে পৌছাতে হবে, এতবড় একটা জার্নি আমার এ অসুস্থ শরীরে সম্ভব নয় বিধায় ভেনিসের টিকেট বাতিল করে রোম থেকে সরাসরি জুরিখে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। এতে অবশ্য বেশ কিছু ইউরো গচ্ছা দিতে হয়েছিল।

সুইজারল্যান্ড বরাবরই আমার জন্য একটা আকর্ষণীয় স্থান। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি এটি পৃথিবীর স্বর্গভূমি। এছাড়া ইউটিউবে এই দেশের বিভিন্ন ভিডিও ও ব্লগ দেখে আকর্ষণ আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়। যথারীতি রোম থেকে জুরিখে ফ্লিক্স বাসে রাতে ৯.৩০ এ রওনা দিয়ে সকাল ৬.০০ টায় পৌঁছালাম। বিশাল এ ১০ ঘন্টার জার্নিতে বাস শুধু এক জায়গায় ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতির জন্য থেমেছিল। এছাড়া বাস যাত্রী নামানোর জন্য ইতালির মিলান ও ফ্লোরেন্স সহ দুইটা স্টেশনেও থেমেছিল। দুতলা ফ্লিক্স বাসটি ভালই ছিল এবং নিচতলা ছোটখাটো একটা ওয়াশরুমও ছিল। ঠান্ডা লাগাতে শরীর আসলেই খুবই খারাপ ছিল তাই বাস জার্নি খুব ইনজয় করেছি বলা যাবে না। কিছুটা ভয় ও আতংক নিয়েই ভ্রমন করছিলাম যাতে পথে অসুস্থ হয়ে না পড়ি।

সকাল ৪ টার দিকে সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করার সাথে সাথে দৃশ্যপট হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল। চারিপাশের আল্পস পর্বতমালা আর এর গা বেয়ে সবুজ বৃক্ষরাজি, পাশে বয়ে চলা স্বচ্ছ লেক, পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন রকমের সুইস বাড়িঘর, খামার, অপরুপ ঝর্না, সবুজ ঘাসে চড়ে বেড়ানো গরুর পাল দেখে আপনার মনেই হতে পারে কোন এক জান্নাতে প্রবেশ করেছি। মনে হচ্ছিল আল্লাহ তাআলা কোরআন শরীফে জান্নাতের যে বর্ননা দিয়েছেন তার কিছুটা প্রতিচ্ছবি পাচ্ছিলাম। অপরুপ দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে জুরিখ শহরে প্রবেশ করলাম। শহরটা খুবই গোছানো। বড় বড় অফিসের দালানগুলো স্বাভাবিক উচ্চতায়, খুব বেশী আকাশ ছোয়া নয়। বাস স্টেশনের পাশেই জুরিখের প্রধান রেল স্টেশন। এর সাথেই সুইজারল্যান্ডের অনন্যা শহরের ও ইউরোপের অনন্যা দেশের রেল স্টেশন সংযুক্ত। সুইজারল্যান্ডের যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমার খুবই ভাল লেগেছে তা হলো সমস্ত শহর জুড়ে সহজ ট্রাম চলাচল। কিন্তু রোমে ট্রেন, মেট্রো, বাস ও ট্রাম মিলে একটি জগাখিচুরী যোগাযোগ ব্যবস্থা যা নতুন কেউ গেলে একটু কঠিন অবস্থাতেই পড়তে হবে। আর যার খেসারত হিসাবে সহজ যোগাযোগের জন্য উবারে চলাচল করতে গিয়ে অনেকগুলো ইউরো গুনতে হয়েছিল।

জুরিখ বাস স্টেশনে নেমে কিছু পর আমাদের প্রিয় দিল আফরোজ আপার দেখা পেলাম। আপা প্রথমেই তারেককে একটা মোবাইল সিমের ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর ট্রামে করে আপার বাসায় পৌছে গেলাম। শরীর অসুস্থ থাকায় আপার বাসায় এসে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিলাম। সকালবেলা দিল আফরোজ আপা অনেক খাবারের আয়োজন করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আপার দেবর আরিফ ভাইয়ের বানানো চিজ পাস্তা। যদিও আমি সাধারন মাছে ভাতে বাঙ্গালী মানুষ, পিৎজা, পাস্তা, বার্গার ফাস্টফুড আমার খুব একটা ভাল লাগে না। কিন্তু পাস্তাটা আসলেই খুব মজা হয়েছিল কিন্তু অসুস্থতার কারনে খুব বেশি খেতে পারিনি। অনেক বড় জার্নি আর অসুস্থার কারনে একটু ঘুম জরুরী হয়ে পড়েছিল। তাই দেরী না করে ঘুমাতে গেলাম।

ঘুম থেকে ওঠে দুপুরের খাবার খেয়ে আরিফ ভা্ইয়ের সাথে জুরিখ লেকে ঘুরতে গেলাম। ভাই যাওয়ার পথে বিখ্যাত বিভিন্ন সুইজ ব্যাংকের কর্পোরেট অফিসগুলো দেখাচ্ছিলেন যেখানে বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশের ধনীদের কোটি কোটি কালো টাকা জমা আছে। মাঝে মাঝে এইসব লোকের প্রতি মায়াও হয় কারন অবৈধ পথে কামানো এই টাকার কথা কাউকে বলতেও পারেনা আর সেই ব্যক্তিও পুরোপুরি ভোগ করে যেতে পারে না। এক সময় সে মারা যাওয়ার পর বিশাল এই টাকা সুইজ ব্যাংকের কাছেই রয়ে যায়। যাহোক হাটতে হাটতে বিভিন্ন দামি দামি দোকানগুলোতে দামি দামি আসবাবপত্র দেখে চোখ আমার চরক গাছ হয়ে যাচ্ছিল। সামান্য একটা গেন্জির দাম বাংলাদেশী টাকা ২ লাখ টাকা, ঘড়ির দাম ২৫ লাখ টাকা, ভাবতে পারেন কি একটা অবস্থা।

জুরিখ লেকের কাছে এসে প্রানটা জুরিয়ে গেল। তিন কিলোমিটারের এই নীলাভ আকাশী জলরাশির চারপাশে সবুজ গাছপালার মাঝে মানুষের বসতি গড়ে ওঠেছে। বিভিন্ন পাখিদের জলকেলি করে উড়ে বেড়ানো আর সুইসবাসীদের তাদের নিজস্ব ছোট বড় বিভিন্ন বোটে করে ঘুরে বেড়ানো, গোসল করার দৃশ্য পরিবেশকে আরো আনন্দিত ও মোহিত করে রেখেছে। আমরা নির্দিষ্ট পোর্টে গিয়ে জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই বিশেষ জাহাজগুলো ১ ঘন্টা পর পর নিদিষ্ট পোর্ট থেকে টুরিস্ট ও স্থানীয় লোকজনদের বিভিন্ন পোর্টে নামায় এবং উঠায়। আমরা জাহাজে ওঠে আশেপাশের অপরুপ সুন্দর দৃশ্যবলী উপভোগ করতে লাগলাম। প্রায় ২ ঘন্টার অপূর্ব জাহাজের ট্যুর উপভোগ করে নেমে হেটে হেটে আশেপাশের বড় বড় গীর্জা, বাসা, কর্পোরেট অফিস, ব্যাংক, সুপারশপ ও রেলস্টেশন দেখতে দেখতে ট্রামে করে বাড়ির পথে হাটা দিলাম।

বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখলাম দিল আফরোজ আপা তার বাসার সামনেই একটা গাড়ি এবং তার সামনে হেলান দেওয়া এক আপার সাথে কথা বলছিলেন। কাছে আসতেই দিল আফরোজ আপা মিতু আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিতু আপা এখানে প্রায় দুই যুগ ধরে আছেন, এখানকার একটা শপিং মলে কাজ করেন, সুন্দর বাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েরা যার যার অবস্থানে ভাল আছেন। মিতু আপার ব্যবহার এতই ভাল যে মূহুর্তের মধ্যে আমাদের আপন করে নিলেন। দিল আফরোজ আপাকে অফার করলেন আমাদের নিয়ে উনার গাড়িতে করে সিটি ট্যুর করাবেন। আমাদের খুবই ভাল লাগল আপার এই আন্তরিকতায়। বিদেশে ঘুরতে গিয়ে দেখেছি, আগের জেনারেশনের বাংলাদেশী অধিবাসীরা তাদের নিজেদের দেশের লোকদের আসলেই অনেক মিস করে। তাই কাছে পেলে পরম মমতায় তাদের কাছে টেনে নেয়, দেশের কথা মনে করে গল্পগুজব করে এক অনাবিল প্রশান্তির মধ্যে চলে যায়। আর আমরাও যারা আগের জেনারেশনের লোক তারাও আসলে বিদেশে গেলে দেশী লোকদের দেখে খুশি হই আর মনে বল পাই দুইটা কথা বলার লোক পেয়েছি বলে। হ্যা এটা ঠিক বিদেশী বাংলাদেশীদের বাসায় থাকলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য হোটেল খরচ বেচে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু সেটাই কি সব, দেশী লোকদের সান্নিধ্য পাওয়া, তাদের সাথে কথা বলার মধ্যে যে আনন্দ পেয়েছি তা টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে বর্তমান জেনারেশনের অনেকের মতামত আবার ভিন্ন। তাদের মতে বিদেশে কারো বাসায় থাকা তাদের মনে হয় তাদের কাছে ঋনী হয়ে থাকার মত, তাই হোটেলে থাকাই তাদের কাছে বেস্ট মনে হয়। যাহোক আমাদের মত জেনারেশনের লোকরা যে কয়দিনই বাচি ভালবাসা আর আন্তরিকতায় বেচে থাকতে চাই।

যাহোক মিতু আপার গাড়িতে করে দিল আফরোজ আপা, আমি ও তারেক রওনা দিলাম। প্রথমে আপা তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন, এরপর যখন বের হলাম তখন বিকাল। আপা প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেলেন খুরহাসস্ট্রিটের (Kurhaussreet) পাহাড়ের উপর ডুলডার গ্রান্ট হোটেলের (Dolder Grand Hotel) সামনে যেখান থেকে পুরো জুরিখ শহরটা দেখা যাচ্ছিল। দুর থেকে ছোট ছোট করে দেখতে পাওয়া জুরিখ লেক, বাড়িঘর, অফিস, আদালত, ধর্মীয় চার্চ ও অন্যান্য ভবনগুলোর আলোক বর্তিকা এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করল যে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ল। এরপর আমরা গিয়েছিলাম ‍স্টেডথাস জুরিখ টাউন হল (Stadthaus-Zurich Town Hall), বুরকলিপ্লাটজ (Burkliplatz) যা লেক দিয়ে ঘেরা একটা মনোরম পার্ক যেখানে বিভিন্ন বড় বড় চার্চ, ইমারত, শপিং মল এবং লোকজনের অবকাশ যাপনের একটা প্রান কেন্দ্র। এর ডান পাশে ফ্রাউমানস্টার চার্চ (Fraumunster Church) যার একটি হ্দয়গ্রাহী গল্প রয়েছে দুই ভাই বোনকে ঘিরে। সম্ভবত ২৮৬ খ্রি ফেলিক্স এবং রেগুলা নামে দুই ভাইবোন যারা ছিলেন জুরিখের ধর্মীয় দুত। তারা ধর্মের জন্য তাদের প্রান দিয়েছিলেন এবং তাদের স্মরনে ফ্রাউমানস্টার চার্চে দুটি মিনারও তৈরী করা হয়েছে। অনেক রাত হয়ে যাওয়াতে মিতু আপা আমাদের দিল আফরোজ আপার বাসায় পৌছে দিয়ে বিদায় নিয়ে নিজ বাসার দিকে রওনা দিলেন। বাসায় এসে দেখি দিল আফরোজ আপা পোলাও মাংস চিংড়ী সহ অনেক লোভনীয় খাবার রান্না করেছেন। যেহেতু আপা কষ্ট করে রান্না করেছেন তাই যতটা পারলাম খেলাম, অসুস্থতার জন্য বেশি খেতে পারলামনা। বেশী রাত না করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন সকালে একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলাম। কিন্তু শরীরটা খারাপ হওয়াতে আর পরে যেহেতু আগামীকাল সকালে ইন্টারলেকেন এবং রাতে বাসে করে ফ্রান্সে যাওয়ার একটা লম্বা ট্যুর আছে তাই সেদিনকার মত বাসায় থেকে বিশ্রাম করার চিন্তা করলাম। তবে তারেক আল্টওয়েসেন স্ট্রেসা (Altwiesen Strasse) যেখানে দিল আফরোজ আপার বাসা তার চারপাশের এলাকা আরিফ ভাইকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল।

পরদিন খুব সকালে ইন্টারলেকেনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মনে মনে একটু উত্তেজনা কাজ করছিল কারন সেদিনই আমাকে ইন্টারলেকেন থেকে এসে রাত ৯ টায় বাসে করে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তাই সময়ের একটু হেরফের হলেই সমস্যা। যাহোক জুরিখের প্রধান রেল স্টেশনের এইচ বি প্লাটফরম থেকে সকাল ৬.৩০ মিনিটে আমরা ইন্টারলেকেনের দিকে রওনা দিলাম। বিশাল এই রেলস্টেশন থেকে ইন্টারন্যাশনাল এবং ডোমেস্টিক ট্রেন পরিচালিত হয়। ইউরোপের উন্নত দেশ সুইজারল্যান্ডের উন্নত রেলস্টেশনের উন্নত ট্রেন ব্যবস্থা সত্যিই আপনাকে আনন্দায়ক ও পুলকিত করবে, যা আমাদের করেছে। নির্দিষ্ট গন্তব্য ইন্টারলেকেনে পৌছাতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন বড় বড় স্টেশন যেমন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন, থোন,স্পাইজ পার হয়ে যেতে হয়েছে । প্রতিটি স্টেশনে যখনি গিয়েছি সেখানকার মনোরম নীল-আকাশী পানির লেকে থাকা ছোট ছোট বোট, লেকের চারিপাশের পর্বতমালা, ঝর্নাধারা, বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙের সুইস কাঠের ঘরবাড়ি, অবারিত সবুজ ঘাসের মাঝে গলায় ঘন্টা বাধা গরুর পাল, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ আমাদের মুগ্ধ করেছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না যে উনি আমাদের মত দুজন ক্ষুদ্র মানুষকে তার এ অপরুপ সৃষ্টি দেখার সৌভাগ্য দান করেছেন।

পুরো সুইজারল্যান্ডই ছবির মত সুন্দর। আগে যখন ইউটিউবে এই দেশের ভিডিও গুলো দেখতাম মনে হতো আসলেই কি এত সুন্দর দেশটা। কিন্তু নিজেদের যখন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল তখন বলতেই হল আসলেই এটা একটা স্বর্গরাজ্য। সুইজারল্যান্ডের ভিতরে এমন আরো অনেক স্থান যা ছবির চেয়েও সুন্দর। এই সব স্থানের একটা হচ্ছে ইন্টারলেকেন। এটি নির্বাচনের প্রধান কারন হল এটি জু্রিখ থেকে সবচেয়ে কাছের স্পট। ইন্টারলেকেন ওয়েস্টে পৌছাতে আমাদের সময় লাগলো ২ ঘন্টা। ছোটখাটো স্টেশন কিন্তু চারপাশ সুউচ্ছ সবুজ পর্বতমালা বেষ্টিত আর তার মাঝে মাঝে মেঘের দলগুলোর ছুটে বেড়ানো কি যে মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে তা বলার মত নয়। দুই লেকের মাঝখানে অবস্থিত বিধায় একে ইন্টারলেকেন নামকরন করা হয়েছে। স্টেশনে নেমেই প্রথমে দুইটা ক্রুসেন্ট আর কফি কিনলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা ও বৃষ্টি আসার একটা ভাব ভাব মনে হচ্ছে। কফি খেয়ে কয়েকজন বিদেশীকে জিজ্ঞাসা করলাম কোনদিকে ভাল ‍প্রাকৃতিক সিনেরিও ও লেক আছে আর ইন্ডিয়ানদের দেখলে জিজ্ঞাসা করতাম শাহরুখের দিলওয়ালে দুলহানিয়া শুটিং হয়েছিল (এটি দিল আফরোজ আপা সুন্দর স্পট নির্ধারনে নির্দেশনা অনুযায়ী একটা সাইন বলেছিলেন) সেই স্পটটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য। কেউ কেউ কনফিউশন নিয়ে মাথা চুলকিয়ে একটা নির্দিষ্ট পথ বলে দিল আবার কেউ কেউ বলতেই পারল না। যাহোক একটা নির্দিষ্ট পথের দিকে হাটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তার চারপাশে দেখতে পেলাম পাহাড় ঘেষে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর, বড় বড় রাজকীয় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন দোকানপাট যার বেশিরভাগই সুবিনিওরের দোকান। কিছুদুর আসতেই পাহাড়ঘেরা বড় মাঠ দেখতে পেলাম যেখানে অনেকে প্যারাসাইক্লিক করছে। মনে হচ্ছিল আকাশফুরে পাহাড়ের মেঘ বেয়ে কিছু পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। দুজনেই আস্তে ধীরে খুব মজা করেই প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বাধ সাধলো বৃষ্টি। ভাগ্য ভালো আরিফ ভাই আসার সময় একটা ছাতা দিয়েছিলেন, তাই রক্ষে। বৃষ্টি থামা পর্যন্ত একটা দোকানের সামনে অপেক্ষা করলাম এরপর আবার হাটা শুরু করলাম। সামনেই যেতে দেখলাম একটা মনোরম লেক এবং একটি ব্রিজ দিয়ে অপরদিকের একটা পাহাড় সংযুক্ত। ব্রিজ পাড় হতেই দেখলাম ক্যাবল কার ফানিকিউলার (Funnicular) যা ৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে হারডারবান (Harderbahn) পাহাড়ের চূড়ার একটি বিশেষ স্থানে নিয়ে যাবে কিন্তু মূল্য পড়বে বাংলাদেশী টাকায় জনপ্রতি ৪০০০ টাকা। পকেট থেকে ৮০০০/- খরচ পড়বে ভেবে একবার পিছিয়ে যাচ্ছিলাম পরে ভাবলাম জীবনে কি আছে আপসোস রেখে লাভ নেই। টিকেট কেটে যখন উঠলাম তখন একটু উত্তেজিত ছিলাম আবার একটু ভয় ভয়ও করছিল, তাই শক্ত করে তারেকের হাতটা ধরে রাখলাম। ক্যবল কার ছাড়ার সাথে সাথে ভয়টা কেটে গিয়ে আনন্দ আর বিস্ময় বেড়ে যেতে লাগল। পাহাড়ের গা ঘেষে যত উপরে উঠতে লাগলাম ততই দেখতে লাগলাম নাম না জানা কত গাছ আর ফুল ফল, দূরের বিস্তৃত আকাশী রংয়ের লেক, পাহাড়, মেঘ, সবুজ ঘাসের মাঠ। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মেঘ আর মেঘ চারপাশে ঘিরে ধরাতে আশেপাশের ভিউ আসলেই কিছু দেখতে পেলাম না। বুঝতে পারলাম নিচ থেকে আমরা যে মেঘগুলোকে পাহাড়ের গায়ে ভেসে থাকতে দেখছিলাম এগুলো আসলে সেই মেঘের শতদল যা আমাদের চাদরের মত ঘিরে রেখেছে। কিছুক্ষন ঘুরাফিরা করে ক্যাবল কারে চড়ে ফিরতি পথ ধরলাম। দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই কিছুটা দৌড়ে কিছুটা হেটে রেলস্টেশনে এসে পৌছালাম।

ইন্টারলেকেন থেকে জুরিখ যাওয়ার পথে অপূর্ব মায়াময় প্রকৃতি দেখতে দেখতে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছিলাম যে উনি আমাকে মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীতে উনার তৈরী ছোট একটা স্বর্গ দেখার তৌফিক দান করেছেন। আর সেই সাথে এই ভেবে বিস্ময় প্রকাশ করি আখেরাতে তার তৈরী জান্নাত কতই না সুন্দর আর বিস্ময়কর হতে পারে।

You may also like...